চাকরির বইয়ের দাম বেশি বেড়েছে বেকারদের খরচ

দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। এসব তরুণের উল্লেখযোগ্য অংশই উচ্চশিক্ষিত। সীমিত কর্মসংস্থানের কারণে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তাঁদের চাকরি পেতে হয়। তাঁদের ঘিরে চাকরি প্রস্তুতির বইয়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বড় হচ্ছে চাকরিকেন্দ্রিক বইয়ের বাজার। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব বইয়ের দাম চড়া।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাঁদের চাহিদামতো কাজ পাচ্ছেন না।

মূলত একটি চাকরি পেতে অধিকাংশ চাকরিপ্রার্থীকে কয়েক বছর ধরে লেগে থাকতে হয়। আবার চাকরি এবং চাকরিসংক্রান্ত পরীক্ষার সঙ্গে অনেকেরই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নের বিষয়ের মিল না থাকায় চাকরির বই কিনে আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়। এভাবে বিস্তৃত হচ্ছে চাকরিকেন্দ্রিক বইয়ের বাজার।

বই দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চাকরির বই। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল-কলেজের বই বিক্রি হলেও চাকরির বই বিক্রি হয় সারা বছর। তাঁরা বলছেন, শুধু চাকরির বই বের করে এমন প্রকাশনীই আছে প্রায় ২৫টি।

Read More:_চাকরির বইয়ের দাম বেশি বেড়েছে বেকারদের খরচ

সারা বছর বিক্রি হয় চাকরির বই

নীলক্ষেত ও বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন চাকরির বইয়ের আলাদা একটি বাজার তৈরি হয়েছে। এসব বইয়ের চাহিদাও সবচেয়ে বেশি। স্কুল-কলেজের বই বাদে দোকানগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চাকরির বই।

নীলক্ষেতের সোহেল লাইব্রেরির মালিক মো. সোহেল বলেন, চাকরি প্রস্তুতির বইয়ের পাশাপাশি আমার দোকানে স্কুল-কলেজেরও বই আছে। তবে সবচেয়ে বেশি চলে চাকরির বই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়ছেন বা সদ্য পড়াশোনা শেষ হয়েছে, এমন ক্রেতাই বেশি।

দোকানে সরাসরি কিনতে আসা ক্রেতাদের পাশাপাশি চাকরির বইয়ের ক্রেতাদের একটি বড় অংশই কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বই কেনেন বলে জানান সোহেল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাকরির বই বের করে এমন প্রকাশনাই আছে প্রায় ২৫টি। তবে সবচেয়ে বেশি চলে ৫-৬টি প্রকাশনার বই। মিরপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরির ম্যানেজার আবদুর রাজ্জাক বলেন, স্কুল-কলেজের বই বিক্রি হয় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু চাকরির বই বিক্রি হয় সারা বছর।

বিসিএসের বইয়ের বিক্রি বেশি

কোন ধরনের চাকরির বই বেশি বিক্রি হয়, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিসিএস পরীক্ষা প্রতিবছরই হয় বলে এই বই বেশি বিক্রি হয় বলে জানান বিক্রেতারা। অবশ্য গত বছর প্রাথমিকের সবচেয়ে বড় শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ায় এ চাকরিসংক্রান্ত বিপুল পরিমাণ বই বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দোকানিরা।

তাঁরা বলেন, বিসিএসে এখন লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন। চাকরির বাজারে প্রথম পছন্দ বিসিএস। তাই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিসিএসের বই। বিশেষ করে একেকটি নতুন বিসিএসের বিজ্ঞাপন প্রকাশের আগে-পরে এসব বইয়ের বিক্রি বেড়ে যায়।

বিসিএসের তিন ধরনের বই বিক্রি হয়। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য আছে আলাদা বই। আবার একেক প্রকাশনীর একেক বই ভালো। ভালো প্রস্তুতির জন্য অনেকেই একই পরীক্ষার জন্য একাধিক প্রকাশনীর বই কিনে থাকেন।

নীলক্ষেত বইয়ের দোকানগুলোর সামনে নিয়মিতই তরুণদের জটলা দেখা যায়। এমনই এক জটলায় দেখা মিলল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান থেকে পাস করা শফিক আহমেদকে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হয়েছে কয়েক মাস আগে। তাই বিসিএসের প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্য সরকারি চাকরির বই কিনতে এসেছি। শুধু শফিকই নন, বই কেনেন এমন তরুণেরা জানান, তাঁরা যেসব চাকরির বই কেনেন এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেনেন বিসিএসের বই। এসব বই পড়লে অন্য চাকরির পরীক্ষায়ও কাজে লাগে।

পরীক্ষার আগে বাড়ে বিক্রি

চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত পরীক্ষার এক বা দেড় মাস আগে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন তাঁরা। বিসিএসের প্রিলিমিনারির আগে এই বিষয়ক বইগুলোর চাহিদা বেড়ে যায়। একইভাবে অন্য সরকারি-বেসরকারি চাকরি বা ব্যাংকের পরীক্ষার আগে সংশ্লিষ্ট বই বেশি বিক্রি হয়।

নীলক্ষেতের বইঘর দোকানের মালিক আলমগীর মিয়া বলেন, বইয়ের বিক্রি এখন মৌসুমকেন্দ্রিক। যেমন প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ বা বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার বইয়ের চাহিদা বাড়ে ওই পরীক্ষাগুলোর আগে।

বইয়ের দাম চড়া

চাকরির বইয়ের দাম বেশি বলে বরাবর অভিযোগ করে আসছেন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা। সম্প্রতি বইয়ের দাম আরও বেড়েছে। তাঁরা বলছেন, কোনো বই থেকে যদি পরীক্ষায় তুলনামূলক বেশি প্রশ্ন কমন পড়ে, তাহলে সেই বইয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে। এতে সুযোগ বুঝে সংশ্লিষ্ট প্রকাশনী বইয়ের দাম বাড়িয়ে দেয়।

এ ছাড়া বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো হালনাগাদ কিছু তথ্য যোগ করে প্রতিবছরই বইয়ের নতুন সংস্করণ বাজারে নিয়ে আসে। এসব সংস্করণে ৩০ থেকে ৫০ টাকা দাম বাড়ানো হয় বলে অভিযোগ করেন ক্রেতারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আমিনুল হক বলেন, প্রকাশনীগুলো জানে বেকার বাড়ছে, তাই চাকরির বইয়ের চাহিদাও বাড়ছে। এই সুযোগে বইয়ের দামও বাড়িয়ে দেয় তারা। আমরাও বাধ্য হয়ে কিনি। তিনি বলেন, বিসিএসের বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ের কোনো বইয়ের দাম দেড় শ টাকার নিচে নয়। কোনো কোনো বইয়ের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ এক সেট বই কিনতে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা লাগে।

বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রকাশনী ও দোকানিরাও। এ জন্য তাঁরা কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতিকে দুষছেন। সোহেল লাইব্রেরির মালিক মো. সোহেল বলেন, প্রকাশনীর পক্ষ থেকে একটি দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এর কম বিক্রি করলে লাভ থাকে না।

চাকরি পাওয়ার আগপর্যন্ত পরিবারের ওপর নির্ভর করেই চলতে হয় বেকার তরুণদের। কারও কারও আয়ের উৎস বলতে টিউশনিই। তা–ও আবার সবাই পান না। অথচ প্রায় প্রতিটি চাকরির আবেদন যেমন টাকা দিয়ে করতে হয়, তেমনি বই কিনতে গিয়েও এখন বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে চাকরিপ্রত্যাশীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *